আগামীকাল ভয়াল ১২ নভেম্বর / অর্ধশত বছর পরও স্বজন হারানোর বেদনা ভূলতে পারেনি উপকূলের বাসিন্দারা

প্রকাশিত: ৯:৪০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১১, ২০২০

আগামীকাল ভয়াল ১২ নভেম্বর / অর্ধশত বছর পরও স্বজন হারানোর বেদনা ভূলতে পারেনি উপকূলের বাসিন্দারা

মনপুরা (ভোলা) প্রতিনিধি ॥
আগামীকালসেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। অর্ধশত বছর পরও স্বজন হারানোর ব্যাথা ভূলতে পারেনি উপকূলের বাসিন্দারা। ১৯৭০ সালের এই দিনে সমগ্র উপকূল জুড়ে বয়ে যায় মহা প্রলয়ংকারী ঘূর্ণীঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। সেই দিন ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বুঝতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে ১০ লক্ষাধিক নিরক্ষর মানুষের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে। বন্যার পানিতে ভেসে যায় গবাধি পশু, হাঁস-মুরগী আর ক্ষতিগ্রস্থ্য হয় ক্ষেতের ফসল, গাছ-পালা, পশু-পাখি। মুহুর্তের মধ্যে ধ্বংস যজ্ঞে পরিণত হয় পুরো উপকূল। চারিদিকে ছিটিয়ে থাকা লাশের গন্ধ ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে আকাশ-বাতাস।
১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী ও চট্রগামের উপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণীঝড় ও জলোচ্ছ্বাস গোর্কি। সেদিন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা দ্বীপ উপজেলা মনপুরা। এদিকে এই দিনটিকে উপকূল দিবস ঘোষনার দাবীতে ১৬ জেলার ৫৪ উপজেলায় একসাথে পালন করা হবে উপকূল দিবস।
এছাড়াও তখনকার পূর্বদেশ পত্রিকার ভোলা জেলা প্রতিনিধি এম হাবিবুর রহমান প্রতিবেদনে পর ভয়াবহ বন্যার ৫ দিন পর রাজধানীসহ পুরোদেশ জানতে পারে। ঘটনা জানার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেড়তলা লঞ্চ করে ত্রান নিয়ে ছুটে আসেন ভোলা, দৌলতখান, তজুমুদ্দিন ও মনপুরায়। দ্বীপ মনপুরার প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে চিন্তা নিবাস স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চিন্তানিবাসের কাজ শুরু হলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর আজও গড়ে উঠেনি চিন্তানিবাস।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ৭ দিন সাগরে ভেসে থাকার পর একটি জাহাজ উদ্ধার করে চট্রগামে নিয়ে যাওয়া ৫ বারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য মফিজা খাতুন এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন সেই দিনের ঘূর্ণীঝড়ের ভয়াবহ ঘটনা।
তিনি জানান, ১৯৭০ সালে ঘূর্ণীঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিজের ৭ সন্তান সহ পরিবারের ৩৫ সদস্যের মৃত্যু হয়। সেই দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার হওয়ার সাথে সাথে বাতাসের তীব্রতা বাড়তে থাকে। কিছুক্ষন পরে ১৫-২০ ফুট উচ্চতায় পানি বেড়ীবাঁধহীন মনপুরার উপর দিয়ে বয়ে যায় জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাসিন্দারা সহ গবাধি পশু। তখন তিনি তার কোলের ৫ মাসের কণ্যা সন্তানকে নিয়ে খেজুর গাছে আশ্রয় নেয়। পরে কোল থেকে কণ্যা সন্তানটি পরে গেলে তাকে ধরার চেষ্ঠা করি। আমাকে প্রচন্ড ¯্রােতে সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমে কাঠ ও পরে বেঁচে থাকার জন্য মরা গরুর লেজ ধরি। পরে লেজ ধরা অবস্থায় সাগরে ৭ দিন ভাসতে থাকি। পরে একটি জাহাজ আমাকে উদ্ধার করে চট্রগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে এক মাস চিকিৎসা শেষে মনপুরায় ফিরে আসি। সাগরে ভেসে যেতে দেখেছেন মানুষের লাশ সহ পশু-পাখি, মরা গবাধি পশুর মিছিল। স্বজনদের কথা মনে করতেই হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলেন সেই দিনের প্রত্যক্ষদর্শী মফিজা খাতুন।
উপকূলে ত্রান নিয়ে বঙ্গবন্ধু ঃ
বন্যার ৫ দিন পর দৈনিক পূর্বদেশ ত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরে দেড়তলা লঞ্চ করে ত্রান নিয়ে ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ভোলা, দৌলতখান, তজুমুদ্দিন ত্রান বিতরন শেষে ছুটে আসেন মনপুরায়। লঞ্চ থেকে মনপুরায় নেমে খালি গা থাকা সাবেক সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর বাবা বশরাত উল্লা চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু গায়ে কোর্ট খুলে পড়িয়ে দেন। পরে তিনি মনপুরায় ত্রান বিতরন করেন। ঘূর্ণীঝড়ে বিধ্বস্ত মনপুরার প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে চিন্তা নিবাস স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চিন্তানিবাসের কাজ শুরু হলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর আজও স্থাপন হয়নি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের চিন্তানিবাস।

উপকূল দিবস ঘোষনার দাবী ঃ
এই দিনটিকে উপকূল দিবস ঘোষনার দাবীতে মনপুরা সহ ১৬ জেলার ৫৪ উপজেলায় একসাথে পালন করা হবে উপকূল দিবস। উপকূলের বন্ধুখ্যাত রফিকুল ইসলাম মন্টুর উদ্যোগে এই দিনটিকে উপকূল দিবস ঘোষনায় সরকারের কাছে দাবী করা হবে।

মনপুরা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কাশেম মাতাববর জানান, ৭০ এর বন্যায় প্রাণ হারায়নি এমন কোন ঘর নেই। স্বজন হারোনোর ব্যাথা আজও ভূলতে পারেনি। এছাড়াও বন্যার পর বঙ্গবন্ধুর ত্রান নিয়ে ছুটে আসেন মনপুরায়। তিনি এখনে একটি চিন্তা নিবাস স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু ৭৫ এর হত্যাকান্ডের পর আজও অজানা কারনে চিন্তানিবাসটি স্থাপন হয়নি। তিনি বঙ্গবন্ধু কণ্যা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিন্তানিবাসটি স্থাপনের জোর দাবী করেন।

এদিকে এই দিনটিকে ঘিরে প্রাণ হারানো স্বজনদের রুহের মাগফিরাত কামনায় নিজ নিজ উদ্যোগে মিলাদ, কোরআন খতম পড়ানো হবে। এছাড়াও মনপুরা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে এই দিনটিকে উপকূল দিবস ঘোষনার দাবীতে সভা সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন পালন করবে বিভিন্ন কর্মসূচী।

সংবাদটি শেয়ার করুন