যেভাবে কারাগারে নির্মমভাবে খুন হন জাতীর চার সূর্য সন্তান

প্রকাশিত: ৭:৪২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২, ২০২৩

যেভাবে কারাগারে নির্মমভাবে খুন হন জাতীর  চার সূর্য সন্তান

জাকিরুল মোমিন
সম্রাট শের-শাহ এর শাসন আমলে ঢাকার লালবাগস্থ চকবাজার এলাকায় তৈরী করা হয়েছিল আফগান দুর্গ। পরবর্তীতে মোগল শাসক সুবেদার ইসলাম খান দুর্গটিকে সংস্কার করে এর এক অংশে অফিস এবং অপর অংশে সামরিক সদর দপ্তর স্থাপন করেন। অতঃপর ১৭৮৮ সালে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে দুর্গটিকে কারাগারে রূপান্তরিত করে এর কার্যক্রম চালূ করা হয়, যা বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নামে পরিচিত। যার শ্লোগান রাখিবো নিরাপদ দেখাবো আলোর পথ। কিন্তু যেখানে বন্দিদের নিরাপদ থাকার কথা আর নিরাপদ রাখার কথা সেখানে নিরাপদ থাকতে পারেনি জাতীয় চার নেতা নির্মম, নিস্ঠুর নৃশংস ভাবে খুন হলেন কারা অভ্যন্তরে।

ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যা নতুন নয়। বহু রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে এই তালিকায় ।কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল কিন্তু সেই বিরল ঘটনাই ঘটেছে ৩ রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে। আসলে ৭৫ এর ১৫ই এর পর থেকেই দেশের অবস্থা ছিলো টালমাটাল। জাতির পিতার হত্যার পর থেকেই দেশের অবস্হা ছিলো নাজুক চলছিল অভুথ্যান পাল্টা অভ্যুথানের মহরা। ৭৫ এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন তারই এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর খুনি মোস্তাক। ক্ষমতা নেওয়ার পরই তিনি সেনা প্রধান লেঃ জেনারেল শফিউল্লাকে বরখাস্ত করেন। নতুন সেনাপ্রধান হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। মোস্তাক ক্ষমতায় থেকেও সস্তিতে ছিলো না। সব সময় ছিলো ক্ষমতা হারানোর ভয় ।

কেন এ নির্মম হত্যকান্ডঃ
৭৫ এর ৩রা নভেম্বর জাতির র্সূযসন্তান জাতীয় চার নেতা তাজ উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম,ক্যাপ্টিন মুনসুর আলি ও এ এইচ কামরুজ্জামাকে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পর . হত্যাকারিরা সবসময় একটা পাল্টা অভ্যুথানের আশঙ্কায় ছিলো ।মোস্তাকের মধ্য সবসময় একটা ক্ষমতা হারানোর ভয় ছিলো । ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ঘনিস্ট সহচর চার নেতাকে ২৩ আগস্ট দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা হয় এবং এর আড়াই মাস পর হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। প্রখ্যাত গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ তার বইতে লেখেন মোস্তাক মনে করেছিলেন পাল্টা একটা শক্তি যদি ক্ষমতায় আসে সেক্ষেত্রে জেলে থাকা চারজনই হবেন সম্ভাব্য নেতা আর এজন্যওই তাদের হত্যা করার একটি কারন ।

কখন কিভাবে হত্যা করা হয় চার নেতাকে

৭৫ এর ৩ রা নভেম্বর মধ্যরাত রাত তখন প্রায় ২ টা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা ফটকের সামনে এটা গাড়ী এসে থামে গাড়িতে ছিলো কয়েকজন সেনা সদস্য। সেনা সদস্যরা কারাফটক খুলতে বলে। আইজি প্রিজন তাৎক্ষনাথ ফোন করে জেলার আমিনুর রহমানকে আসতে বলেন।
আমিনুর রহমান এসে দেখেন কারাফটকের সামনে একটা পিকআপে কিছু অস্ত্র সজ্জিত সেনা সদস্য।
মূল ফটকের সামনে তারা আইজি প্রিজনকে একটা চিঠি দেন। বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে জেলার আমিনুর বলেন চিঠিতে কি লেখা ছিলো আমি জানিনা। আমিনুর রহমানের পাশের কক্ষের টেলিফোন বেজে উঠে। বঙ্গভবন থেকে ফোনটি এসেছিলো। বলা হলো আইজির সাথে কথা বলবেন। আমিনুর ফোনটা দেওয়ার পর প্রেসিডেন্টের সাথে আইজির কথা হলো। টেলিফোন রেখে জেলারকে বললো প্রেসিডেন্ট বলেছেন সেনা সদস্যরা যা করতে চায় তা যেন করতে দেয়া হয়। খুলে গেলো ফটকের দ্বার ভিতরে ঢুকলো খুনিরা।৷ আইজি একটা কাগজ দিলো জেলারের হাতে তাতে লেখা ছিলো দেশের চারজন দেশপ্রেমিকের নাম। সৈয়দ তাজ উদ্দিন ,ক্যাপ্টিন মুনসুর আলী, সৈয়দ নজরল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে জেলার খুনিদের নিয়ে গেলো চার নেতাদের রুমে। জেলার আমিনুরের ভাস্যমতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর তাজউদ্দীন আহমেদ একটি কক্ষে আর ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী আর কামরুজ্জামান আরেকটি কক্ষে ছিলো। ক্যাপ্টিন মুনসুর আলী আর কামরুজ্জামানকে যখন রুম থেকে আনা হয় তার আগে সে কাপড় পাল্টাচ্ছিলো তাদের আনা হয় তাজউদ্দীনের রুমে তাজউদ্দীন আহমদ তখন পবিত্র কোরআন পড়তে ছিলো। তারা তখনও জানতো কি হচ্ছে তাদের সাথে। একত্রিত অবস্থায় খুব কাছ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে তাদেরকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। জাতীয় চার নেতাকে একত্রে গুলি করা হলে তিনজন সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আরমএতে নেতৃত্ব দেন রিসালাদার মুসলেমউদ্দীন যে ১৫ই আগষ্ট শেখ মনির বাসায় হামলা করে তাদের খুন করে ছিলো। তাজউদ্দিন আহমেদের পায়ে ও পেটে গুলি লাগার কারণে তিনি গুলির পরও অনেক সময় বেঁচে ছিলেন। রক্তক্ষরণের ফলে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পরে মারা যান। পাশের সেলে কারাবন্দিরা জানিয়েছিল, গুলির পরও প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে একজনের আর্তনাদ শুনেছিলেন তারা। আর ‘পানি, পানি’ বলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাঁতরানোর মর্মভেদী শব্দ তাদের কানে আসছিলো। কিন্তু বর্বর ঘাতক মুসলেউদ্দিন গ্যাং চলে যাবার আগে সেলটিকে খুব শক্তভাবে তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়ায় মৃত্যুর আগে প্রবাসি সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের মুখে এক ফোঁটা পানিও কেউ তুলে দিতে পারেনি। ওই পিপাসা নিয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাজউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশের চার সূর্য সন্তান যারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্বে ছিলো যাদের প্রচুর অবদান তারাই খুন হলেন এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার দ্বারা। আমরা পরাজিত হই অমোঘ সত্যের কাছে মৃত্যু সেই অলঙ্ঘনীয় অনিবার্য সত্যের নাম। জাতীয় চার নেতাও পরাজিত হলেন মৃত্যুর কাছে আর সেটা হতে হলো কারাগারের মতো নিরাপদ জায়গায় যা ইতিহাসে বিরল।

সংবাদটি শেয়ার করুন